প্রারম্ভিক বানীঃ বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন দিবস পালন হয়ে থাকে। বাবা দিবসও তেমনি একটি দিবস। পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে উৎসর্গ করে যে দিনটি পালন করা হয় তাকে বাবা দিবস বলে। আসলে পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন হয়না, তারপরও বিশেষ ভাবে স্মরণ করে রাখার জন্যই এ দিনটির আয়োজন।
কেন বাবা দিবসঃ
পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশেই বাবা হচ্ছেন পরিবারের প্রধান। পরিবারের প্রধান হিসেবে নানান দায়িত্বের বোঝা থাকে তার কাঁধে। বাবা হওয়ার মতো গুরু দায়িত্বের কারণে তাকেই সইতে হয় বাইরের সব রকম যন্ত্রনা। আবার ঘরের ব্যাপারাগুলোও তাকে ভুলে থাকলে চলে না। ছেলে-মেয়েদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিষয়টিও তার নজরে রাখতে হয়। পরিবারের প্রধান হিসেবে সকল ভালো-মন্দের দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়। বাবা-মা নিজের সব প্রয়োজনকে অবহেলা করে আপনার প্রয়োজন পূরণ করেছেন, নিজের সব আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে আপনার আরামের চেষ্টা করে গেছেন। আপনার অসুস্থতায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। তাদের ত্যাগের প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়, অনুভব করা সম্ভব। তাই সব সময় বাবাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং শ্রদ্ধার সাথে বিশেষ ভাবে স্মরণ করে রাখার জন্যই আমরা এ দিনটিকে পালন করব।
বাবা দিবসের ইতিহাসঃ
১৯০৯ সালে ডড দেখলো মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য একটি দিন আছে কিন্তু বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের কোনো দিন নেই। তাই ডড ভাবলো মা দিবসের মতো বাবা দিবস থাকা প্রয়োজন। কিন্তু তার এ ভাবনা যখন অন্যরা শোনে তখন হেসেই উড়িয়ে দিল। এমনকি তাকে নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা শুরু করে দিল। কিন্তু ডড এতে ভীষণ কষ্ট পেলেও দমলো না একদম, বরং তার মধ্যে জেদ আরো প্রবল হয়ে উঠলো। সে বাবা দিবস পালনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলো। প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমে সে সফল হলো। পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ সালে ওয়াশিংটনের স্পোকান নামে ছোট্ট শহরে (ডডের নিজ শহর) কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে পালিত হলো বাবা দিবস।
তারপর ১৯১৬ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এ দিবসকে সমর্থন করেন। এক সময় এটা তাদের জাতীয় আইনসভাতেও স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশ বাবা দিবস পালনঃ
বাবা দিবসের পালনের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। তারপরও বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮৭টি দেশ দিবসটি পালন করে। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের ৫২টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। মা দিবসের মত বাবা দিবসও বিশ্বের সকল দেশে একই দিনে পালন হয় না। এমনকি বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালনের রীতিতেও কিছু পার্থক্য রয়েছে।
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করে বেশ কিছু দেশ। এগুলো হচ্ছে; বাংলাদেশ, অ্যান্টিগুয়া, বাহামা, বুলগেরিয়া, কানাডা, চিলি, কলাম্বিয়া, কোস্টা রিকা, কিউবা, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, গ্রিস, গায়ানা, হংকং, ভারত, আয়ারল্যান্ড, জ্যামাইকা, জাপান, মালয়েশিয়া, মাল্টা, মরিশাস, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তান, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, ফিলিপাইন, পুয়ের্টো রিকো, সিঙ্গাপুর, স্লোভাকিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, সুইজারল্যান্ড, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ে।
ইরনে বাবা দিবসঃ ১৪ মার্চ। লিভিয়া, ইটালি, হন্ডুরাস, পর্তুগাল ও স্পেন বাবা দিবসঃ মার্চ মাসের ১৯ তারিখ।
দক্ষিণ কোরিয়ায় বাবা দিবসঃ প্রতিবছর মে মাসের ৮ তারিখ, লিথুনিয়ায় বাবা দিবসঃ জুন মাসের প্রথম রবিবার, ডেনমার্কে বাবা দিবসঃ ৫ জুন, অস্ট্রিয়া, ইকুয়েডর ও বেলজিয়াম বাবা দিবসঃ জুনের দ্বিতীয় রবিবার, এল সালভেদর ও গুয়েতেমালা বাবা দিবস পালন করে ১৭ জুন। নিকারাগুয়া, পোল্যান্ড ও উগান্ডা ২৩ জুন পালন করে বাবা দিবস।
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উরুগুয়ে জুলাই মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালন করে বাবা দিবস। ডমিনিকান রিপাবলিক জুলাই মাসের শেষ রবিবার দিবসটি পালন করে।
আর্জেটিনা বাবা দিবস পালন করে ২৪ আগস্ট। ব্রাজিল বাবা দিবস পালন করে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় রবিবার। আগস্টের ৮ তারিখে বাবা দিবস পালন করে তাইওয়ান ও চিন।
সেপ্টেম্বর মাসের পূর্ণিমায় বাবা দিবস পালন করে নেপাল। সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার বাবা দিবস পালন করে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড। লুক্সেমবার্গ বাবা দিবস পালন করে ৫ অক্টোবর এবং একই মাসের দ্বিতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করে এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এবং সুইডেন। থাইল্যান্ড ৫ ডিসেম্বর বাবা দিবস পালন করে।
ইসলামে বাবা-মায়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বঃ
ইসলামী নীতি অনুযায়ী বাবা দিবস পালনের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু ইসলাম বাবা-মায়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের সেবা-যত্ন করা, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের মান্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ। বাবা-মা’কে কষ্ট দেয়া, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, তাদের কথা অমান্য করা নিঃসন্দেহে অনেক বড় অন্যায়।
আল কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত না করতে ও বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে (সূরা বনি ইসরাইল-২৩)।
কোরআনে আরও বলা হয়েছে, তাদের একজন বা উভয়েই জীবদ্দশায বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ‘উফ’ বল না। তাদের ধমক দিও না, তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বল (সূরা বনি ইসরাইল-২৩)।
হাদিস শরীফে এসেছে, একবার জনৈক সাহাবি নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে জিহাদে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবা-মা কেউ কি জীবিত আছে? সাহাবি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বাড়িতে গিয়ে তাদের সেবা কর (বুখারি শরীফ, হাদিস নং-২৮৪২)।
শুধুমাত্র একটিমাত্র দিনের জন্য পিতা-মাতার খোঁজ-খবর করতে চায় তারা মূলত মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের নির্দেশের খেলাপ কাজ করে।
বাবাকে নিয়ে আমার কিছু কথাঃ
পৃথিবীর সকল ছেলে-মেয়েদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা বাবাকে শুধু বাবা দিবসের মধ্যে সীমিত রাখবেন না। দিবস পালন করে বাবার ঋণ শোধ করা যাবে না। তাই এক জন সন্তান হিসেবে যা করবেনঃ
- মা-বাবার কোনো ভুল আচরণে রাগান্বিত হবেন না, সব সময় মনে রাখবেন তাদের মাধ্যমেই আপনি পৃথিবীতে এসেছেন। - মা-বাবাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে সম্মান করুন এবং তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করুন।
- যে কোন কাজ করার আগে বাবা-মায়ের পরামর্শ ও দওা নিন।
- আপনার শিশু সন্তানের যেমন যত্ন নিন, বয়োবৃদ্ধ মা-বাবাকে তেমন যত্ন নিন, কারণ এই মা-বাবাই আপনাকে লালন-পালন করে বড় করেছেন।
-বাবা-মার কাজে সাধ্যমতো সহযোগিতা করুন।
বিভিন্ন ভাষায় পিতাঃ
বাংলা ভাষায়ঃ বাবা বা আব্বা, জার্মান ভাষায়ঃ ফ্যাট্যা, ড্যানিশ ভাষায়ঃ ফার, আফ্রিকান ভাষায়ঃ ভাদের, চীনা ভাষায়ঃ বা ,ক্রী(কানাডিয়ান) ভাষায়ঃ পাপা,ক্রোয়েশিয়ান ভাষায়ঃ ওটেক ,পর্তুগিজ, ভাষায়ঃ পাই,ডাচ ভাষায়ঃ পাপা,ইংরেজি ভাষাইয়ঃ ফাদার, ড্যাড, ড্যাডি, পপ, পপা বা পাপা,ফিলিপিনো ভাষাঃ তাতেই, ইতেই, তেয় আর আমা,হিব্রু ভাষায়ঃ আব্বাহ্,হিন্দিভাষারঃ পিতাজী, ইন্দোনেশিয়ান, ভাষায়ঃ বাপা কিংবা আইয়্যাহ, জাপানিজ ভাষায়ঃ ওতোসান, পাপা, পুর্ব আফ্রিকান ভাসায়ঃ বাবা
হাঙ্গেরিয়ান ভাষায়ঃ পাপা
বাবাহীন ছেলের জন্য মায়ের চোখে জলঃ
(সিঙ্গাপুরের একটি মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত, বাংলাদেশী ছেলে এবং চাইনিজ মেয়ের বাস্তব প্রেমের কাহিনী অবলম্বনে, সংক্ষিপ্ত গল্প, উল্লেখ্য এখানে আমি ওদের ছদ্ম নাম ব্যবহার করেছি।)
বিজন,
খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি কেমন আছো? আমি জানি আমার এ লেখা, হয়ত বা কোন দিন দেখবে না। তবু আমার এই অবুঝ মনকে বুঝিয়ে রাখতে পারিনা। বিজন, আমার রক্তে মাংসে নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে শুধু তুমি আর তুমি, কি কিরে তোমায় ভুলব, বল? আমার মধ্যে আমি বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই, সবই শুধু তুমি, শুধু তুমি আর তুমি। বিজন, আমার খুব করে মনে পড়ছে, তুমি (MRT) মেট্রো রেলে কাজ করতে, প্রতিদিন অফিসে যাবার সময় দেখা হত তুমি আমার দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকতে,
আর আমি তুমাকে পাত্তাই দিতাম না! তবু কেমন করে, কখন যেন আমার রক্তের সাথে মিশে গেছ
বুঝতেই পারিনি! বিজন, সেই স্মৃতি মনে পড়ে, চোখে আনান্দ অশ্রু ঝরে, যে দিন হারিয়ে গিয়েছলাম
দুজন দুজনাতে, এক অজানাতে, মনের অজান্তেই হয়েছিল দুজনার মিলন। বিজন, এক সাইক্লনের কথা মনে পড়ছে যে সাইক্লোন শুরু হয়েছে কিন্তু শেষ কোন দিন হবে কি না আমার জানা নেই। যে দিন তোমাকে বলেছিলাম বিজন, আমি তোমার অস্তিত্ব আমার দেহে বহন করে চলছি। আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি তোমার বসকে, আমাদের বিষয়টি খুলে বল। এর পরের দিন থেকে বেশ কিছু দিন
তোমার খবর ছিলনা। একদিন হঠাৎ একটি ফোন নম্বর থেকে আমার নাম্বারে ফোন আসে, আমি ফোন রিসিভ করি তুমি শুধু এটুকুই বললে লিলি, আমার কোম্পানি আমাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো, জীবনে আর কখনো তোমার সাথে দেখা হবে না। বিজন, এই সাইক্লোন এখনো আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলছে_____ রক্তাক্ত করে চলছে আমার হৃদয়কে______ এ সাইক্লোন কি থামার মত বিজন? বিজন, আমি অনেক চেষ্টা করেছি ঐ নাম্বারে, কিন্তু নাম্বারটি ছিল
একটি টেলিকম শপের, তারা তোমার কোন ঠিকানা দিতে পারেনি। আমি গিয়েছি তোমার কোম্পানির কাছে, তারা বলেছে, সিঙ্গাপুরের আইনে কোন (ভিসা)WP ধারীকে কোন সিঙ্গাপুরিয়ান বিয়ে করতে পারে না। বাধ্য হয়েই তারা তোমাকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। বিজন, আমি তোমার জন্য সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে, তোমার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে রেখেছি। তুমি চলে এসো আমার কাছে।
আমি এখনো তোমার অপেক্ষায়, তোমার জন্য আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করব। মৃত্যুর আগেও যদি একনজর তোমায় দেখে যেতে পারি তবু আমি শান্তি পাব। বিজন, তুমি ছাড়া আমার বেঁচে থাকা আর না থাকা সমান কথা, তবু বেঁচে আছি, কেন জান? তুমি আমাকে যে অস্তিত্বের জানান দিয়ে গিয়েছিলে, ও এখন পাঁচ বছরের ছেলে। অন্তত ওর জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে হবে। কিন্তু বিজন, ছেলেমেয়েরা যখন তাদের বাবার সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যায় তখন তাদের দেখে ও যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়, তখন আমি তাকে চোখের অশ্রু ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি।
ইতি
তোমার
লিলি বিজন
শেষ বানিঃ
পৃথিবীতে যদি কোন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকে তা হল, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যে ভালোবাসা। সন্তানের জন্য বাবা-মা নিজের জীবন উত্সর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। কিন্তু তিক্ত সত্য হলো, কালপরিক্রমায় আমরা হয়ে উঠি অতি নির্মম। বাবা-মায়ের প্রতি আমাদের চরম অবহেলা ও অবজ্ঞা। তাই সকলের প্রতি আমার অনুরোধ বাবাকে শুধু বাবা দিবসে সীমিত না রেখে সর্ব সময় বাবা-মাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা দিয়ে ভরে রাখি।